মাংসের কারবার

মশিউল আলম

Illustration by Emily S. Franklin

ঈদের সাত দিন আগে একদিন খুব ভোরে বউ আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলল, ‘তাড়াতাড়ি যাও।’

যে-লোক সকাল নটার আগে কোনোদিনই বিছানা ত্যাগ করতে পারে না, তার সঙ্গে এমন ব্যবহার অত্যাচার ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারি না, আপনাদের মতো আমিও বউকে ভয় পাই। না, মারের ভয় না, বউ আর যাই করুক, মারে-টারে না আমাকে। ভয় পাই অশান্তির। বউয়ের কোনো-কিছুর প্রতিবাদ করলে অশান্তি ঘটে। আমি ভাই অশান্তি চাই না। আমি বড় নির্ঝঞ্ঝাট লোক।

তার উপর্যুপরি গুতাগুতি আমার আলস্যের বারোটা বাজিয়ে দিল। কিন্তু কী ব্যাপার, এই কাক-ডাকা ভোরে কোথায় কী দরকারে যেতে হবে কিছুই বুঝতে পারলাম না। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললাম, ‘কোথায় যাব?’

‘ভুলে গেছ এরই মধ্যে? কাল রাতে বললাম না? মাংস কিনতে যাও। ঈদ এসে গেল। আজকালের মধ্যেই মাংসের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। ওঠো ওঠো!’

পাশের ঘরেই ঘুমাচ্ছে দামড়া শ্যালক। তাকে পাঠিয়ে দিলেই পারত। কিন্তু এই হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরে গুণধর ভ্রাতাকে কষ্ট দিতে ছিঁড়ে যাবে ভগিনীর প্রাণ। তাই অগত্যা আমাকেই উঠতে হলো। জ্যাকেটের হাতার মধ্যে হাত গলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘কয় কেজি?’

‘দশ কেজি।’

দশ কেজি মাংস খাবে কে? না ভাই, মুখ ফুটে উচ্চারণ করিনি। শুধু মনের মধ্যে প্রশ্নটা জাগল। তা জাগুক, বউদের সামনে মনের সব প্রশ্ন উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা সংসারে কজন পুরুষেরই বা আছে!

টাকা গুনছি আর ওদিকে বউয়ের উপদেশ বর্ষণ চলছে : ‘মাংস ভালো করে দেখে নিবা। দেখবা, যেন ভেজাল দিতে না পারে। সে জন্যেই এত সকালে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে। ভেড়া বা বকরি জবাই করে খাসির মাংসের সঙ্গে মিশালে তুমি চোখের সামনেই ধরে ফেলতে পারবা। যাও যাও, তাড়াতাড়ি করো।’

 


ভোরের ধোঁয়াশার মধ্যেও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে: পূর্ব রাজাবাজার জনপ্রিয় মাংসভান্ডার। এখানে উন্নত মানের খাঁটি খাসির মাংস পাওয়া যায়। দোকানের সামনে জনা তিনেক খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার কালো পিচ কালচে লাল রক্তে ভেজা। একটা খাসি গলাকাটা অবস্থায় পড়ে আছে। তার পাশে দোকানের একজন লোক পটু হাতে চড় চড় শব্দ তুলে করে একটা ভেড়ার চামড়া খসাচ্ছে। তাদের পাশে আর দুজনে মিলে জবাই করছে একটা হাড্ডিসার দাড়িওয়ালা ছাগী, সেটির ওলানখানা শুকিয়ে কিসমিস।

তিন খদ্দের নির্বিকার চেয়ে চেয়ে দেখছে। তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি নির্বিকার; কোনো তাড়াহুড়ার ভাব নেই। তারা সুবোধ ভদ্রলোকের মতো অপেক্ষা করছে। মাংসবিক্রেতারা আমাদের ভ্রুক্ষেপ করছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা মশগুল হয়ে ভেড়া ও ছাগীর চামড়া ছাড়ানোর কাজ করে চলেছে। কিন্তু গলাকাটা অবস্থায় যে-খাসিটা পড়ে আছে, আগে সেটার চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রির উপযোগী করে মাংস কাটা হয়নি কেন, তা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার সাধারণ জ্ঞান থেকেই এসে গেল : ভেড়া ও ছাগীর মাথা কেটে, চামড়া ছাড়িয়ে তারা আগেভাগেই সেগুলো সরিয়ে ফেলবে। তারপর খাসির মাংসের সঙ্গে ভেড়া ও ছাগীর মাংস ভেজাল দিয়ে বিক্রি শুরু করবে।

যাতে এই জালিয়াতির শিকার হতে না হয়, আমার বউ সে জন্যই আমাকে এত আগেভাগে এখানে পাঠিয়েছে। এবার আমি মনে মনে বউয়ের বুদ্ধির প্রশংসা করলাম। আমাকে অন্তত এরা ভেজাল মাংস দিতে পারবে না।

পটাপট ভেড়া ও ছাগীর চামড়া ছাড়ানোর কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। তারপর তারা নিমেষের মধ্যে খাসিটার  চামড়াও খসিয়ে ফেলল। অন্য খদ্দেররা এবার নড়েচড়ে উঠল। আমি তাদের একজনকে ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমাকে দশ কেজি খাসি।‘

খাসির সামনের দুই পা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে করতে দোকানি বলল, ‘অয়েট করেন।’

ওদিকে একই কায়দায় ভেড়া ও ছাগীটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্য তিনজন খদ্দের আমার আগে এসেছে বলে আগে তাদের জন্য মাংস মাপা শুরু হলো। খাসি, ছাগী ও ভেড়ার দেহ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে মাংস, হাড়, চর্বি ইত্যাদি কেটে কেটে একসঙ্গে মিশিয়ে দাঁড়িপাল্লায় তোলা হচ্ছে। খদ্দেররা কিছু বলছে না, কোনো আপত্তি করছে না; তাদের চোখমুখে এমন নির্বিকার ভাব, যেন-বা এটাই নিয়ম।

আমি খদ্দেরদের একজনকে বললাম, ‘কী ব্যাপার ভাই? এসব কী হচ্ছে?’

লোকটা আমার দিকে চেয়ে এমন একটা ভঙ্গিতে হাসল, যেন আমি একটা নির্বোধ, যেন মাংস কেনার কোনো অভিজ্ঞতাই আমার নাই। বাকি দুজন খদ্দেরও আমার দিকে তাকিয়ে একই ভঙ্গিতে হাসল। কেবল মাংসের দোকানের লোকেরা গুরুতর কেজো ভঙ্গিতে মাংস কাটা ও মাপার কাজ করে চলল।

আমি দোকানিদের একজনকে বললাম, ‘আমাকে দশ কেজি খাসি দেন।‘

‘দিতাছি ছার, এট্টু অয়েট করেন।‘ বলে সে তার পাশের সহকর্মীকে বলল, ‘অই ছলেমান, ছারের জন্যে দশ কেজি।‘

লম্বা, ঢ্যাঙা, চোয়াল-ভাঙা, লাল-চোখ, সিগারেট-ঠোঁটে ছলেমান হাত বাড়াল ভেড়ার দিকে। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উঁহুঁ উঁহুঁ করে উঠলাম, ‘ভেড়া না, ভেড়া না! আমি খাসির কথা বললাম।‘

‘এহানে ভেড়ার মাংস বিক্রি হয় না, ছার।‘ প্রথম লোকটা অন্য একজন খদ্দেরকে মাংস দিতে দিতে বলল।

আমি ভেড়ার ধড় আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখিয়ে তাকে বললাম, ‘এইটা কী?’

‘খাসি, সব খাসি।‘ ঢ্যাঙা ছলেমান নির্বিকারভাবে বলতে বলতে ভেড়ার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছুরি চালাতে লাগল।

‘তোমাদের এই খাসি আমি নিব না।‘ আমি আসল খাসিটার অবশিষ্টাংশের দিকে আঙুল নাড়িয়ে বললাম, ‘আমাকে এইখান থেকে যতখানি হয় দাও।’

‘অইব না।’ দোকানির তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে অন্য খদ্দেররা হো হো করে হেসে উঠল।

‘কেন? হবে না কেন?’ আমি বেশ কড়া সুরে দোকানিকে বললাম।

দোকানি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘অইব না।’

‘ক্যানো হবে না?’ আমি চিৎকার করে উঠলাম।

‘যান, গ্যাঞ্জাম কইরেন না।’

‘গ্যাঞ্জাম মানে? বাটপারী নাকি? চোখের সামনে ভেড়ার মাংসকে খাসির মাংস বলে চালাচ্ছেন…!’

‘চিল্লাইয়েন না, চুপচাপ বাসায় যান গিয়া।’

‘অই মিয়া, বাসায় যাব মানে? মগের মুল্লুক পাইছ নাকি?’

‘হ পাইছি। গরম দেহায়েন না, যান।’

‘কীসের গরম, অই মিয়া জালিয়াত?’

‘ভালোই ভালোই যান গিয়া। নাইলে খারাপ অইব।’

‘হুমকি? হুমকি দিচ্ছ আমাকে?’

‘হ দিতাছি। অহনই চোপা বন্ধ কইরা বাসায় যান গিয়া, নাইলে..’

আমি সাহসী লোক না। কসাইদের মুখে এ-রকম গুরুগম্ভীর ঠান্ডা সুরের হুমকি শুনে আমার আতঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি একটুও ভয় পেলাম না। বরং অস্বাভাবিক রকম রেগে গেলাম। প্রায় মারমুখী ভঙ্গিতে বললাম, ‘নাইলে কী? কী করবে তুমি আমার?’

দুটা লম্বা চাপাতির মুখ পরস্পরের সঙ্গে সশব্দে ঘষাঘষি করে ধার দিতে দিতে আমার দিকে লাল চোখ তুলে ঢ্যাঙা ছলেমান বলল, ‘জবাই করুম।’

আমার মাথাটা চরাৎ করে উঠল। কোনো দোকানদার কোনো ভদ্রলোক ক্রেতাকে এমন কথা বলতে পারে? কী ভেবেছে এরা আমাকে? চিৎকার করে উঠলাম, ‘শুয়োরের বাচ্চারা, চিনিস আমাকে? জানিস আমি তোদের কী করতে পারি? আমি তোদের এই বাটপারী ব্যবসার লালবাতি জ্বালিয়ে তোদের সবকটাকে…’

আমার কথা শেষ না হতেই প্রথম কসাইটা কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাড়িয়ে আমার টুঁটি চেপে ধরল। ইতিমধ্যে মাংস কিনতে আসা আরো কয়েকজন খদ্দেরসহ আগের লোকগুলো গোল হয়ে ঘিরে দৃশ্যটা দেখার জন্য তৈরি হতে লাগল। আমি গোঁ গোঁ শব্দ করে দুই হাতের সবগুলো আঙুল মেলে দিয়ে আস্ফালন করতে লাগলাম। দম বন্ধ হয়ে আমার চোখের মণিদুটো বেরিয়ে আসার জন্য চক্রাকারে ঘুরতে আরম্ভ করে দিল।

আমার টুঁটি চেপে ধরে কসাইটা আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে দোকানের প্রাচীরের সঙ্গে ঠেসে ধরল। ঢ্যাঙা ছলেমান একটা লম্বা চকচকে ছুরি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। কসাইদের আরো যে-দুতিনজন সঙ্গী ছিল তারা এগিয়ে এসে আমাকে আছড়ে-পিছড়ে ধরে রাস্তায় চিৎ করে ধরাশায়ী করে ফেলল। আমি চিৎকার করতে করতে পা আছড়াতে লাগলাম। কিন্তু মাংস ক্রয়েচ্ছু ভদ্রলোকেরা নীরব দর্শকের মতো চেয়ে রইল। কেউ আমাকে সাহায্য করার জন্য বা কসাইদের নিবৃত্ত করার জন্য এগিয়ে এল না। কেউ কোমরে হাত রেখে, কেউ এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ফুটপাথে বানরখেলা দেখার মতো শিশুসুলভ কৌতূহলী চোখে দৃশ্যটা দেখতে লাগল।

আমার তুমুলভাবে আছড়ানো পায়ের লাথি খেয়ে কসাইদের একজন ছিটকে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন ছুটে এসে আমার দুই পা ভীষণ শক্ত করে ধরে টেনে সোজা করে জোড়া হাঁটুর উপর দুজনেই চড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর-একজন আমার হাতদুটি ধরে টেনে আমার মাথার পিছন দিকে নিয়ে দুই হাঁটু দিয়ে রাস্তার পিচের সঙ্গে ঠেসে ধরে রইল। আমার আর একটুও নড়াচড়া করার সাধ্য রইল না। ঢ্যাঙা ছলেমান আমার শেভ-না-করা খরখরে থুৎনিটা বাম হাতে শক্ত করে ধরে মাথার পিছন দিকে টানতে লাগল। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাথা বুকের দিকে এনে থুৎনি দিয়ে গলা আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু ঢ্যাঙা ছলেমানের হাতে আসুরিক শক্তি, সে এমন প্রবলভাবে আমার থুৎনিটা পিছনের দিকে ঠেলতে লাগল যে আমার ঘাড়ের হাড্ডিতে মট্ মট্ শব্দ উঠতে লাগল। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেলাম ছলেমানের দুই লাল চোখ যেন আগুনের দুটি বল। তার নাকের ফুটা দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দে গরম বাতাস বেরিয়ে এসে আমার চোখমুখ পুড়িয়ে দিতে লাগল। উপরের পাটির দাঁত দিয়ে সে তার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লম্বা চকচকে ছুরিসমেত ডান হাতটির কনুই ভাঁজ করল।

 


ঢ্যাঙা ছলেমানের লম্বা চকচকে ছুরিটা আমার টানটান গলায় চেপে বসে সামনের দিকে তীরবেগে ছুটে গিয়ে এক মুহূর্ত থেমেই পিছনে এসে আরও গভীর পথে আবার সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল, আর আমার আত্মা আমার দেহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গেল। সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে, যেন-বা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে, আমি দেখলাম, আমিনুল ইসলামের (আপনাদের সংসারে এটা আমার নাম ছিল) কাটা গলার উপর ঝুঁকে-পড়া ঢ্যাঙা ছলেমানের হাতে লম্বা ক্ষুরধার ছুরিটা আরও গভীর হয়ে আবার সামনে এগিয়ে গেল এবং এবার পিছনের দিকে ফিরে আসার পথে সেটি গলার মাংস, চর্বি, অস্থি, তরুণাস্থি ইত্যাদির আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আমিনুলের কাটা গলা থেকে একটা প্রধান ধারায় রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল গলগল করে, আর বিভিন্ন শিরাউপশিরা থেকে রক্ত বেরুতে লাগল পিচকারির মতো চিকন ধারায় ও অপেক্ষাকৃত তীব্র বেগে। একইভাবে আরও বার-তিনেক ছুরি চালানোর পর ছলেমান যখন তার হাত প্রত্যাহার করে নিজের চোখমুখের রক্ত হাতের চেটোয় মুছতে লাগল, তখন আমিনুলের দেহটা রাস্তার কালো পিচের উপর ধড়াস ধড়াস শব্দ করে লাফাতে লাগল, তার হাত-পাগুলো বিভিন্ন ভঙ্গিতে বিভিন্ন দিকে আস্ফালন করতে করতে এক সময় নিস্তেজ হয়ে এল।

আমিনুলের গলার কাটা জায়গাটা আকাশের দিকে হাঁ মেলে আছে। তার স্থির চোখের মণিদুটো বিস্ফারিতভাবে ডান দিকে চেয়ে আছে। মাংস ক্রয়েচ্ছু ভদ্রলোকেরা গোল হয়ে ঘিরে নামাজে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বুকে অথবা নাভির কাছে হাত বেঁধে আমিনুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা অপেক্ষা করছে। তারা অতিশয় সুবোধ ভদ্রলোক। তারা কোনো ঝুট-ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে ভালোবাসে না। তারা অন্যের কোনো ব্যাপারে নাক গলায় না। তারা মাংস কেনে। তারা জানে গরুর মাংসের সঙ্গে মহিষের মাংস ভেজাল দেওয়া হয়। খাসির মাংসের সঙ্গে ভেড়ার ও ছাগীর মাংস ভেজাল দিয়ে খাঁটি খাসির মাংস বলে বিক্রি করা হয়। তারা এইসবে বেশ অভ্যস্থ। তারা কোনো দিন মহিষের বা ভেড়ার মাংস কিনবে বলে দোকানে-বাজারে যায় না। তারা জানে এ-শহরে ভেড়ার, ছাগীর বা মহিষের মাংস কিনতে পাওয়া যায় না। তারা প্রতিদিন রাতে শহরের রাস্তায় ঝাঁক ঝাঁক ভেড়া, ছাগী ও মহিষ দেখতে পায়। কিন্তু তারা জানে এ-শহরে ভেড়ার মাংস বিক্রি হয় না, ছাগীর মাংস বিক্রি হয় না, মহিষের মাংস বিক্রি হয় না। ভেড়ার মাংসকে খাসির মাংস হিসাবে কিনতে এবং খেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না।

শুধু মাংসের কারবারে নয়, সমাজ-সংসারের কোনো ব্যাপারেই তাদের মনে কোনো অশান্তি, অসন্তোষ, অসুবিধা বোধ হয় না। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের মানুষ। বিলাতের লোকেরা জনমত জরিপ চালিয়ে এই তথ্য উদঘাটন করেছে।

কিছুক্ষণ আগে আমি যখন আমিনুল ইসলাম ছিলাম, তখন ওইভাবে জবাই হওয়ার মুহূর্তে তাজ্জব হয়ে ভাবছিলাম, দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেছে? (কেউ একজন সম্ভবত এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয় শুধু তখনই, যখন সে নিজে জবাই হওয়ার মতো বিপদে পড়ে।) তখন আমার ভাবনা হচ্ছিল, এভাবে প্রকাশ্য দিনের আলোয়, রাস্তার উপরে এতগুলি লোকের সামনে একটা মানুষকে জবাই করার চেষ্টা হচ্ছে, এটা কি আদৌ সম্ভব? আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে সেটা সম্ভব। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও আমার মনে হচ্ছিল, কসাইগুলো ক্ষেপেছে বটে, কিন্তু জখম-টখম যা-ই করুক, জবাই অন্তত করবে না। রাগের বশে একটা মানুষকে একেবারে জবাই করে ফেলা, তাই হয় নাকি?

কিন্তু আমি ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই ব্যাপারটা ঘটে গেল। আমিনুল ইসলামের দেহ-কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার পরে আমি দেখতে পেলাম, হয়, এই দেশে এমন ঘটনা খুব সহজেই ঘটে। এর চেয়েও অভাবনীয় (আপনাদের জন্য। অভাবনীয়, কল্পনাতীত, অসম্ভব, নজিরবিহীন, রোমহর্ষক ইত্যাদি নানা রকম শব্দ ব্যবহার করতে করতে আপনারাই দেখতে পাচ্ছেন দিনে ও রাতে, রাতে ও দিনে কত রকমের কাণ্ড-কারখানা আপনাদের সামনে ঘটে চলেছে। আপনারাই ঘটিয়ে চলেছেন।) ব্যাপার-স্যাপার এখানে হরদম ঘটে চলেছে।

আমিনুলের ঘাড়ের নিচে এক খন্ড কাঠ রেখে ঢ্যাঙা ছলেমান একটা ভারি দা দিয়ে বেশ জোরে একটা কোপ বসাল। কটাস শব্দে আমিনুলের মুন্ডু তার ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ডান হাতের দাখানা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে সে খামচে ধরল আমিনুল ইসলামের মাথার এক গাছি চুল, কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াল, তার হাতে ঝুলতে লাগল আমিনুলের মুন্ডু। আমিনুলের চোখ দুটো আগের মতোই ডান দিকে চেয়ে আছে। ছলেমান মু-ুটা দোলাতে দোলাতে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেল। এদিকে দুজন আমিনুলের ধড়টা ধরাধরি করে নিয়ে চলল ঢ্যাঙা ছলেমানের পিছু পিছু। দোকানের ভিতরে গিয়ে ছলেমান আমিনুলের মুন্ডুটা মেঝেতে রেখে দা-এর উল্টা পিঠ দিয়ে সেটার মাঝ-বরাবর একটা ঘা বসাল, ফ্যাট করে একটা শব্দ উঠল, কিন্তু এত সহজে আমিনুলের মগজ বেরিয়ে এল না। গরু-ছাগলের মগজ বের করা একটুখানি মেহনতের কাজ, মানুষের মাথার খুলির হাড় গরু-ছাগলের মাথার হাড়ের চেয়ে নরম নয়। ঢ্যাঙা ছলেমানকে মেহনতে নামতে হলো। সে আরও গোটা দুয়েক ঘা বসিয়ে খুলিটার এক অংশ ফাটাতে সক্ষম হলো। তারপর কাজটা সহজ হয়ে এল। খুলির ভিতর থেকে সে আমিনুলের মগজ বের করে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রেখে দুই হাতের তালু আর আঙুলগুলো ব্যবহার করে বেশ সুন্দর করে উপস্থাপন করল।

ওদিকে অন্য দুজন অনভিজ্ঞতাবশত খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভাবতে লাগল, আমিনুলের চামড়াটা কীভাবে ছাড়ানো যায়। মানুষের চামড়া তো গরু, ছাগল বা ভেড়ার চামড়ার মতো পুরু আর লোমশ নয় যে চড় চড় করে তা দেহ থেকে ছাড়ানো যাবে। আমিনুল লোকটা দেখতে মোটেই নাদুস-নুদুস ছিল না। কিন্তু তার চামড়া ছাড়ানোর জন্য ছুরি চালাতে গিয়ে কসাইরা দেখতে পেল, তার অতি পাতলা চামড়ার নিচে শুধুই চর্বি। চর্বি আর চামড়ার মাঝখানে আঙুল ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে চামড়া খুলে আনার চেষ্টা করতে গেলেই চামড়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে আসছে।

এতে বরং সুবিধাই হলো। কে একজন বুদ্ধি করে বলল, ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে আমিনুলের দেহটাকে ছালহীন করা খুবই সহজ কাজ হবে। ততক্ষণে রাস্তার উল্টা পাশের ‘রুচিতা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ খুলে গেছে। সেখান থেকে এক বালতি ফুটন্ত গরম পানি এনে আমিনুল ইসলামের দেহ থেকে ছাল তুলে ফেলা হলো। তারপর খুব করিৎকর্মা হাতে তার দেহ খন্ড–বিখন্ড করে কাটা আরম্ভ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমিনুলের ৬৫ কেজি ওজনের দেহটা থেকে কমপক্ষে ৪৫ কেজি বিক্রয়যোগ্য মাংস বের করে ফেলল।

খাসি, ভেড়া ও ছাগীর মাংসের সঙ্গে আমিনুল ইসলামের চর্বিযুক্ত মাংস মিশিয়ে খাঁটি খাসির মাংস হিসাবে বিক্রয় আরম্ভ হলো। খদ্দেররা শান্তিপূর্ণভাবে, সরল-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাংস ক্রয় করে নিজ নিজ ঘরের পথে ফিরে যেতে লাগল। তারা জানে মাংসের বাজারে বিশুদ্ধ খাসির মাংস বলে কিছু নাই। ভেড়ার ও ছাগীর মাংস তাতে ভেজাল দেওয়া হয়। যদি তার সঙ্গে একটা মানুষের মাংসের ভেজাল দেওয়া হয়ে থাকে, তাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। অতএব মাংসের কারবার যেমনটি চলে, তেমনিভাবে চলতে লাগল। কোথাও কোনো বিকার নাই।

 


সকাল সাতটা বেজে গেল, কিন্তু মাংস নিয়ে আমিনুল ইসলাম ফিরে এল না দেখে আমিনুলের স্ত্রী ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে তার অকর্মা স্বামীটার উদ্দেশে বকাঝকা আরম্ভ করে দিল। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাত পার হয়ে যখন আটটার ঘর ছুঁতে গেল, তখন রুবিনা সুলতানা বা আমিনুল ইসলামের স্ত্রী তার ছোট ভাইটিকে ধাক্কা দিয়ে সুখনিদ্রা থেকে তুলে বসাল।

‘তোর দুলাভাইয়ের কান্ড দেখছিস? মাংস কিনতে গেছে সেই কখন, এখনও ফিরে আসার নাম নাই। ঠিকই কোথাও আড্ডায় বসে গেছে। আসুক আগে, আজ আমি তার আড্ডার মজাটা টের পাওয়াব। ওঠ্ তো, ওঠ্। গিয়ে দশ কেজি খাসির মাংস নিয়ে আয়। আহারে, এখন কি আর খাঁটি মাংস পাওয়া যাবে! ভেড়া-বকরির ভেজাল দেওয়া মাংসই খেতে হবে, মেহমানদের খাওয়াতে হবে। কী হলো, উঠতেছিস না ক্যান? কথা কানে যাচ্ছে না?’

‘আমি দশ কেজি আনব, ওদিকে দুলাভাইও যদি দশ কেজি নিয়ে আসে, এত মাংস রাখবা কই?’

‘রাখব তোর মাথায়। তোর দুলাভাইয়ের কি মনে আছে নাকি যে আমি তাকে মাংস কিনতে পাঠাইছি? সে তো সব ভুলে খেয়ে কোথাও চুটিয়ে আড্ডা মারতেছে। পকেটের টাকা পকেটে নিয়েই ফিরে এসে জিবে কামড় দিয়ে বলবে, ভুলে গেছিলাম। তার ভুলে যাওয়া আজ আমি বার করব। কী হলো, ওঠ্।

‘তুমি কেন মনে করতেছ দুলাভাই কোথাও আড্ডা মারতেছে? কোনো অ্যাক্সিডেন্টও তো হইতে পারে। ছিনতাইকারীই ধরল নাকি তাই বা কে জানে!

‘বক বক করিস না। এই তিন মিনিটের রাস্তায়, পাড়ার মধ্যেই ছিনতাইকারী ধরতে আসবে, না? আমি ওরে চিনি না?’

পাড়ার মধ্যেই, তিন মিনিটের হাঁটাপথে আমিনুল ইসলামকে যদি ছিনতাইকারীরা ধরে টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে তার পেটে ছুরি বসিয়ে দিত তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু রুবিনা সুলতানা বা আমিনুল ইসলামের স্ত্রীর মনে তেমন কোনো শঙ্কা জাগেনি। এদেশে মানুষেরা আর শঙ্কার মধ্যে বাস করে না। তারা দেখতে পায়, পাশের বাড়ির লোকটা দিনেদুপুরে রাস্তার মাঝখানে খুন হয়ে গেল, গার্মেন্ট কারখানা থেকে কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে তরুণীকে অকস্মাৎ শিয়ালের মুরগি ধরার মতো করে ধরে নিয়ে রাস্তার পাশেই দুটি বাড়ির মধ্যিখানের চিপায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে গেল কয়েকটা তরুণ, পানের দোকানি দশ টাকা কম চাঁদা দিয়েছে বলে তার দোকানে পেট্রোল ঢেলে দোকানিকেসুদ্ধ সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দিল, কিন্তু সকলেই মনে করে, এসব গজব নাজিল হবে অন্যদের উপর। আমি নিরাপদ, আমার কিছু হবে না।

রুবিনা সুলতানাও স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধের অধিকারী। তার স্বামী ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছে এমন নিশ্চিত সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত সে মনে করবে অমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কারো বেলায় ঘটলে ঘটতে পারে, তার স্বামীর বেলায় ঘটেনি। মাংস কেনার কথা ভুলে গিয়ে তার স্বামী নিশ্চিন্তে কোথাও বসে বসে চা খাচ্ছে এবং চুটিয়ে আড্ডা মারছে।

 


আমার শ্যালক দশ কেজি খাসির মাংস কিনে বাসায় ফিরে এসেছে। এর মধ্যে আমার নিজের দেহের ঊরু, বাহু এবং পাঁজরের মাংস আছে, চর্বি আছে, এবং বুকের ও পাজরের কিছু নরম হাড়ও আছে। ঈদ উপলক্ষে কেনা হলেও ভাই তার বোনকে আজ দুপুরে খানিকটা মাংস রান্না করতে বলে। বোন ভাইকে বড় ভালোবাসে, সে কিছু খেতে চেয়েছে, আর বোন তা দেয়নি এমন ঘটনা কষ্মিনকালেও ঘটেনি। বোন বেশ যত্ন করে, অনেক মশলাপাতিসহযোগে মাংস রান্না করে।

তারপর দুপুরবেলা ভাইবোনে এক সঙ্গে খেতে বসে। ভাইয়ের পাতে বোন আদর করে মাংস তুলে দেয়, নিজের পাতেও নেয়।

আমি চিৎকার করে উঠি : ‘রুবিনা, খেয়ো না। রুবেল, খেয়ো না।’

কিন্তু আমার চিৎকার বোধ হয় শব্দহীন। আমি তো শব্দের জগৎ ছেড়ে চলে এসেছি।

আমার বউ আমার বুকের একটা হাড়ে কামড় বসিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে ভাইয়ের তারিফ করে, ‘দারুণ মাংস এনেছিস রুবেল। এখন থেকে মাংসটা তুইই কিনতে যাস ভাই। তোর দুলাভাইটা কোনো কাজেরই না…!’